আমরা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ যেটা জানি সেটা হলো দ্বীনও যেটা ধর্মও সেটা।
কিন্তু বিষয়টা কি আদতে এক? অধিকাংশ মানুষই এ ব্যাপারে উদাসীন।
আল্লাহ বলেন,
وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না। (সূরা আনআম-৩৭)
ধর্ম বাংলা শব্দ । যার ইংরেজি হলো Religion বা ঈশ্বরে বিশ্বাস । শাব্দিক অর্থ বিশ্বাস হলেও ধর্ম আরও ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে । যেমন ।
আগুনের ধর্ম পোড়ানো,
চুম্বকের ধর্ম আকর্ষণ করা,
পানির ধর্ম ভেজানো।
ঠিক একইভাবে মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব, মানুষের প্রতি মানুষের মায়া-মমতা ইত্যাদি।
ধর্ম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। বিভিন্ন কারণে ধর্ম সম্পর্কে এই নিয়মের প্রবর্তণ করা হয়েছে। ধর্ম হতে হলে চারটি জিনিস থাকতে হয়।
১।Founder of the religion বা প্রবর্তক
২।Geneses বা সৃষ্টিতত্ত্ব
৩।Ritual বা আচার-অনুষ্ঠান
৪।Ethical code বা নৈতিক বিধান।
মোটাদাগে বলতে গেলে এভাবে বলতে পারি যে যুগ যুগ ধরে পুরুষানুক্রমে যে বিশ্বাসের লালন করে আসছি তাই ধর্ম। যার কিছু আচারসর্বস্ব রীতিনীতি আছে , লোকমুখে প্রচলিত আছে নানা কাহিনী,যার কোনোটার ব্যাখ্যা আছে আবার কোনোটার নেই।
কিন্তু দ্বীন ধর্মের মতো হলেও ধর্ম নয়। যেমনভাবে সকল বন্ধু মানুষ হলেও সকল মানুষই বন্ধু নয়। দ্বীনের বিশালতা, ব্যাপ্তির সাথে ধর্মের তুলনা করা মানে দ্বীনকে খাটো করা।
দ্বীন(دين) আরবী শব্দ। শাব্দিক দিক থেকে সোজা বাংলায় যার অর্থ জীবনব্যবস্থা (Complete Code of Life)।
আল্লাহ বলছেন,
ﺇِﻥَّ ﺍﻟﺪِّﻳﻦَ ﻋِﻨْﺪَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼﻡُ
নিশ্চয় আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন/জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম।
(আল ইমরান-১৯)
ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺃَﻛْﻤَﻠْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﺩِﻳﻨَﻜُﻢْ ﻭَﺃَﺗْﻤَﻤْﺖُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻧِﻌْﻤَﺘِﻲ ﻭَﺭَﺿِﻴﺖُ ﻟَﻜُﻢُ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼﻡَ ﺩِﻳﻨًﺎ
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে/জীবনব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করলাম। আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর পূর্ণতা দিলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন/জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।
(মায়েদা-৩)
ﻭَﻣَﻦْ ﻳَﺒْﺘَﻎِ ﻏَﻴْﺮَ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼﻡِ ﺩِﻳﻨًﺎ ﻓَﻠَﻦْ ﻳُﻘْﺒَﻞَ ﻣِﻨْﻪُ
‘কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন/জীবনব্যবস্থা চায় তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।’
(আল ইমরান-৮৫)
পারিভাষিক দিক থেকে জীবনে চলার পথে স্রস্টাপ্রদত্ত রীতিনীতি,নিয়মকানুই দ্বীন।
এছাড়াও কিছু অর্থ আছে যেমন مالك يوم الدين বা প্রতিদান দিবসের মালিক ।
ﻛَﻠَّﺎ ﺑَﻞْ ﺗُﻜَﺬِّﺑُﻮﻥَ ﺑِﭑﻟﺪِّﻳﻦِ
না, তা নয়, বরং তােমরা প্রতিদানকে মিথ্যা মনে করেছে।
(সুরা ইনফিতার-৯)
এখানে দ্বীন অর্থ প্রতিদান ।
ﻭَﻗَٰﺘِﻠُﻮﻫُﻢْ ﺣَﺘَّﻰٰ ﻟَﺎ ﺗَﻜُﻮﻥَ ﻓِﺘْﻨَﺔٌ ﻭَﻳَﻜُﻮﻥَ ﭐﻟﺪِّﻳﻦُ ﻟِﻠَّﻪِۖفَإِنِ انتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ
আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যতক্ষণ না ফেতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয়। যদি তারা বিরত হয় তবে জালেমদেরকে ব্যাতীত আর কাউকে আক্রমণ করা চলবে না।
(আল বাক্বারা -১৯৩)
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে।
(আত তাওবাহ্ - ৩৩,সূরা ফাতাহ্-২৮,সূরা সফ-০৯)
এখানে دين শব্দের বাংলা অর্থ দ্বীনই রাখা হয়েছে।
আল- কুরআনুল কারীম
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনুদিত।
কোনো কোনো বাংলা অনুবাদে কোথাও দ্বীন আবার কোথাও ধর্ম দেয়া হয়েছে ।
যে যাই বলি না কেন আল্লাহর দেয়া জীবনবিধান তথা দ্বীন আর আচারসর্বস্ব ধর্ম যে এক নয় তা আমরা ভুলে গিয়েছি। ফলে ইসলামের মতো বিশাল,উদার পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধানকে মসজিদ,মাদ্রাসা আর পাঁচ ওয়াক্তে নামাজের মধ্যে আবদ্ধ রেখে বলছি ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। এটাকে বাইরে আনা ঠিক না, ধর্মের পবিত্রতা আমরা বিশেষ কায়দায় রক্ষা করছি।
কেন ভাই دين এর বাংলা অর্থ দিতে বাঁধা কোথায়? কুরাণে বেশ কিছু শব্দের বাংলা অর্থ তাই দেয়া যা আরবীতে দেয়া। যেমন।
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ ۖ هُوَ الرَّحْمَـٰنُ الرَّحِيمُ
(আল হাশ্র - ২২)
তিনিই আল্লাহ তা’আলা, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নাই; তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা; তিনিই দয়াময় পরম দয়ালু।
এখানে إِلَـٰهَ এর বাংলা ইলাহ দেয়া। কেন এর কি বাংলা অর্থ নাই?
অবশ্যই আছে। শাব্দিক অর্থ হলো হুকুমদ্বাতা। পারিভাষিক দিক থেকে إِلَـٰهَ এর অর্থ হলো মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে যার হুকুম চলবে তিনিই ইলাহ তথা হুকুমদ্বাতা। আজ إِلَـٰهَ কে উপাস্য দিয়ে অনুবাদ করে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ উপাস্য মানে আচারসর্বস্ব কিছু ধর্মীয় রীতি বুঝালেও "হুকুমদ্বাতা" শব্দের অর্থের বিশালতা ব্যাপক।
আজ মুসলিম উম্মাহকে এই একটা জিনিস ভুলিয়ে চর্বিত চর্বণ খাওয়ানো হচ্ছে আর আমরাও খেয়ে যাচ্ছি। যতোদিন না আমরা ইলাহ্ আর উপাস্যের পার্থক্য, ধর্ম আর দ্বীনের পার্থক্য বুঝবো ততোদিন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো না।
পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজারের মতো ধর্ম আছে। কিন্তু দ্বীন/জীবনব্যবস্থা কয়টা আছে?
এগুলো গুগুল মামাকে জিজ্ঞেস করলে পাওয়া যায় কিন্তু জীবনব্যবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে মামা চুপ মেরে যায়। কারণ আসল জিনিসটাকে ধর্মের মোড়কে আড়াল করে ভিন্ন কিছু আমাদেরকে গেলানো হচ্ছে । দ্বীনের ভেতর ধর্ম পাওয়া যায় কিন্তু ধর্মের ভেতর দ্বীন পাওয়া যায় না।
"সকল বন্ধুই মানুষ কিন্তু সকল মানুষই বন্ধু নয়।"
আজ আমরা ধর্ম পালন করে জান্নাত আশা করছি সেইসাথে দ্বীন অস্বীকার করে শেরকও করছি।
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُم بِاللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشْرِكُونَ
অনেক মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে।
(সূরা ইউসুফ-১০৬)
মন্তব্য করুন এখানে