নির্বাচিত লেখা

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে রসুলাল্লাহর (সা.) সংগ্রাম

আল্লাহর রসুল (সা.) মানুষ কেনাবেচার দাসত্ব প্রথাকে নির্মূল করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। এই সংগ্রাম কেবল যে কাফেরদের বিরুদ্ধে তা নয়......

আমরা চাই ইসলামী সমাজ গড়তে

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২১

ঘটনা-১

গতকাল আমাকে হেযবুত তওহীদের একজন ভাই ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আমি ফ্রি আছি কি না, কিছু কথা আছে। তার কণ্ঠে উদ্বেগ, মনে হলো বড় কোনো সমস্যার মধ্যে আছেন। আমি বললাম- ফ্রি আছি, আপনি বলুন। বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো, তার সারসংক্ষেপ এই যে-

তিনি হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের অন্য একটি ভাইকে কথা দিয়ে আঘাত করেছেন, তিনি বুঝতে পারেননি যে, ঐ কথা তাকে অতটা আঘাত দেবে। যাইহোক, সাথে সাথেই তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, তিনি একটি বড় ভুল করে ফেলেছেন। কোনো মো’মেন ভাই-বোনের মনে আঘাত দেওয়া নিশ্চয় বড় ভুল, বড় পাপ। তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন, তারপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চান, যাকে আঘাত দিয়েছেন তার নিকটও ক্ষমা চান, কিন্তু এতেও তার মন শান্ত হচ্ছে না। তাই তিনি আমাকে কল দিয়ে করণীয় জানতে চাইলেন। 

হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম

আমি তাকে বললাম- কারো সাথে অন্যায় করলে বা কারো মনে আঘাত দিলে ৫টি পদক্ষেপ নিতে হয়-

১. প্রথমে নিজের ভুলের জন্য আগে অনুশোচনা করা, ভুল হয়েছে এটা উপলব্ধি করা, অনুতপ্ত হওয়া।

২. যার কাছে ভুল করেছেন তার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া।

৩. আল্লাহর নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করা।

৪. কাফ্ফারা আদায় করা। কিছু অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করা যেতে পারে, ১০-২০ রাকাত নফল সালাহ্ করা যেতে পারে, নফল সওম করা যেতে পারে অথবা এক বা একাধিক দরিদ্র মানুষকে খাওয়ানো যেতে পারে।

৫. সবশেষ একই ধরনের পাপ বা ভুল যেন পুনরায় না হয় এজন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা ও আল্লাহর জিকির (প্রতিটা কর্মে আল্লাহর স্মরণ) করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

প্রথম তিনটি পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেই আমাকে কল দিয়েছিলেন কাজেই বাকি ছিল শেষ দুই পদক্ষেপ। আমার সাথে কথা বলে তিনি কিছুটা হালকা হলেন।

ঘটনা-২

আমাদের মতো দরিদ্র দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাই এমন যে, সমাজের বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। যেহেতু হেযবুত তওহীদ আন্দোলন সর্বশ্রেণির মানুষকে নিয়ে কাজ করে, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে যুক্ত হয়েছে কাজেই এ আন্দোলনের একটা বড় অংশই দরিদ্র। আবার একটা বড় শ্রেণি আছে যারা আন্দোলনে যোগ দেবার পরে এমনভাবে সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, এমনভাবে আল্লাহর রাস্তায় দান করেছেন এবং দীনের কাজে সময় দিয়েছেন যে, তারা ধনী থেকে মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র হয়ে গেছেন। তাদের এই জীবন-সম্পদের কোরবানিই আন্দোলনকে বেগবান করে।

যাইহোক, গত শীত মৌসুমে আন্দোলন থেকে তালিকা করা হয় যে, কার কার শীতের বস্ত্র, গরম কাপড়, লেপ-তোশক ইত্যাদির সমস্যা আছে। জুম’আ মসজিদ থেকেও খোঁজ নেওয়া হয়। তালিকা অনুযায়ী সকলের অংশগ্রহণে শীত বস্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়। এরপরও খোঁজ নিয়ে জানতে পারি কেউ কেউ আত্মসম্মান বোধের কারণে শীতের কষ্ট করলেও উপরে জানায়নি। আমরা যারা দায়িত্বশীল ছিলাম, তারা বাসায় বাসায় গিয়ে, আমাদের স্ত্রীদের বাসায় বাসায় পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করিয়ে তাদের লেপ-তোশকের ব্যবস্থা করি। আমাদের মসজিদ থেকে সব সময় উদ্বুদ্ধ করা হয় যেন সর্বদা আমরা একে অন্যের খোঁজ-খবর রাখি।

ঘটনা-৩

২০২০ সালের শুরুতে যখন বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, বিভিন্ন দেশে লকডাউন দেওয়া হচ্ছে তখনই হেযবুত তওহীদের মাননীয় এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম হেযবুত তওহীদের দায়িত্বশীলদের নিয়ে মিটিং করেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে, আন্দোলনের মধ্যে যারা ডাক্তার আছেন তাদেরকে নিয়েও মিটিং করেন। আমাদের দেশে যখন লকডাউন শুরু হয়ে গেল তখন তিনি অনলাইনে কনফারেন্স করে প্রতিনিয়ত সকলের খোঁজ-খবর নিতে লাগলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিতে লাগলেন। একদিকে চিকিৎসার জন্য প্রতিটা জেলা শাখার উদ্যোগে মেডিকেল টিম গঠন করলেন, কেন্দ্রীয়ভাবেও মেডিকেল বোর্ড গঠন করলেন, হটলাইন নাম্বার ঠিক করলেন যেন প্রতিটা জেলা শাখা থেকে এমনকি গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষও যোগাযোগ করে চিকিৎসা নিতে পারে। 

জেলা পর্যায়ের দায়িত্বশীলগণ গ্রামে-গঞ্জে সাইকেলে, মোটর সাইকেলে ঘুরে ঘুরে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন, বাড়িতে বাড়িতে ঔষধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করেছেন। অন্য দিকে যারা ঢাকা শহরে চাকরি হারিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন তাদেরকে মাননীয় এমাম গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আন্দোলনের প্রতিটা শাখার উদ্যোগে দেশব্যাপী নানামুখী কৃষি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। মাননীয় এমাম নিজেও মাঠে নেমেছেন, কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করেছেন, আন্দোলনের সদস্যদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। নারী-পুরুষ সকলকেই বাড়ির আঙিনা, ঘরের ছাদ, ডোবা, নালা এক কথায় প্রতি ইঞ্চি মাটি, প্রতিটা জলমহলকে উৎপাদনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, এর ফলও আমরা এখন পাচ্ছি। সারা দেশে আমাদের উদ্যোগে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয়েছে তাতে অন্তত হেযবুত তওহীদের কোনো সদস্যকে না খেয়ে থাকতে হবে না ইনশাল্লাহ।

ঘটনা-৪

মাননীয় এমাম সম্প্রতি একটা শাখাতে সফর করেন। সেখানে তুলনামূলক সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি। বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও হেজরত করে অনেকেই মাননীয় এমামের ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে এসে নানামুখী প্রকল্প চালু করেছে। মাননীয় এমাম ছোট ছোট গ্রুপে করে মিটিং করে করে প্রত্যেকের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। প্রত্যেকটা ভাই-বোনকে প্রশ্ন করে করে জানছেন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, তাদের বাসস্থান, তাদের খাবার-দাবার ইত্যাদির বিষয়ে। লকডাউনের কারণে কিছু ভায়ের সমস্যার কথাও তিনি জানলেন। তিনি তাদের ঐ সাময়িক সমস্যার সমাধান করেই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি ঢাকাতে ফিরে সারা দেশের সকল মোজাহেদ-মোজাহেদার সাথে অনলাইন কনফারেন্স করে খোঁজ নিতে শুরু করলেন। 

সেই কনফারেন্সেও সেই সমস্যাগ্রস্ত ভাইদের বিষয় তুলে ধরলেন। স্বল্প আয়ের কারণে যাদের বাসা ভাড়া করে থাকতে সমস্যা হচ্ছে তাদের আবাসন সমস্যা কীভাবে দূর করা যাবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করলেন, যাদের কর্মসংস্থানের সমস্যা হচ্ছে তাদের কীভাবে একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে তা নিয়ে কথা বললেন, এক কথায় যখনই হেযবুত তওহীদের কোনো সাধারণ সদস্যেরও সামান্য কোনো সমস্যা হয় তখন যেন মাননীয় এমামের ঘুম হারাম হয়ে যায়, তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সেটা যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করার চেষ্টা করেন।

আমাদের কাছে এই হলো ইসলামের আসল রূপ। আমরা এমন একটা সমাজ গঠনের চেষ্টা করছি যেখানে প্রত্যেকে একে অন্যের খোঁজ-খবর নেবে, একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। কেউ অসুস্থ হলে অন্য মো’মেন ভাই-বোন দৌড়ে যাবে তার সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য, কেউ অভাবে পড়লে অন্যরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। সবচেয়ে পুণ্যের কাজ মনে করবে অন্যের উপকার করা, অন্যকে ভালোবাসা আর সবচেয়ে পাপকর্ম মনে করবে অন্যকে ঠকানো, অন্যের ক্ষতি করা, অন্য মো’মেন ভাই-বোনের সাথে প্রতারণা করা। তারা নামাজ পড়তে যাবে মসজিদে কিন্তু কেবল নামাজ পড়াকেই ধর্ম মনে করবে না বরং নামাজের পরে একে অন্যের খোঁজ নেওয়াকেই প্রকৃত ধর্ম মনে করবে। নামাজের যিনি ইমামতি করবেন তিনি বেতনভুক্ত দাস হবেন না বরং তিনি হবেন সমাজের নেতা, সকলের নানামুখী সমস্যার সমাধান করবেন তিনি, আর মুসল্লী বা মুক্তাদীগণ তার সিদ্ধান্তের, তার কথার আনুগত্য করবে যেমনভাবে সালাতের (নামাজের) মধ্যে ইমামকে অনুসরণ করা হয়।


আমরা এমন সমাজ নির্মাণের চেষ্টা করছি যেখানে কেউ বেকার থাকবে না, কেউ গৃহহীন থাকবে না, কেউ অসহায় থাকবে না। আমরা এমন জাতি গঠন করতে চাই যে জাতি তাদের নিজেদের খাদ্য সমস্যার জন্য, নিজেদের অর্থনীতিক সমস্যার জন্য অন্য জাতির নিকট হাত পাতবে না।


আমরা লেবাসী ইসলাম ধারণ করতে চাই না, আমরা চাই আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম আমাদের অন্তরে, আমাদের চরিত্রে ধারণ করতে, ইসলামী সমাজ গঠন করতে। 

সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভালোবাসায় পূর্ণ এক সমাজ গড়তে চাই। আমরা যদি মিথ্যা বলি তাহলে আমাদের কণ্ঠনালী চেপে ধরে বলুন- ‘কেন তোমরা মিথ্যা বলছ?’, আমরা যদি কারো কোনো ক্ষতি করি তাহলে আমাদের গালে চড় দিয়ে বলুন- ‘কেন তোমরা অন্যের ক্ষতি করছ?’, আমরা যদি অন্য ভাইকে বিপদে ফেলে রেখে নিজেরা উদরপূর্তি করি তাহলে আমাদের কাছে জবাব চান- ‘কেন তোমরা স্বার্থপরতা করছ?’ কিন্তু দয়া করে আমাদেরকে এ প্রশ্ন করবেন না যে, কেন আমাদের গায়ে জোব্বা নেই, কেন আমাদের মাথায় টুপি নেই, কেন আমাদের অনেকের মুখে দাড়ি নেই, কেন আমরা আপনাদের সাথে নানা ইস্যুতে মাঠে নেমে ভাঙচুরে অংশ নিচ্ছি না, কেন আপনাদের কথিত ‘ঈমানী’ দাবিগুলোর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে মাঠে নামছি না ইত্যাদি।