নির্বাচিত লেখা

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে রসুলাল্লাহর (সা.) সংগ্রাম

আল্লাহর রসুল (সা.) মানুষ কেনাবেচার দাসত্ব প্রথাকে নির্মূল করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। এই সংগ্রাম কেবল যে কাফেরদের বিরুদ্ধে তা নয়......

দেশি তালেবানদের উত্থান ও ভবিষ্যৎ

প্রকাশিত: এপ্রিল ০৭, ২০২১

আফগানিস্তানের মাটিতে তালেবানরা যেই “জবরদস্তিমূলক” ইসলাম কায়েম করতে গিয়ে সারা বিশ্বের সমালোচনা কুড়িয়েছিল, সেই একই জবরদস্তিমূলক ইসলাম আমাদের দেশে কাদের অন্তরে লালিত-পালিত হয়, কারা নারীবিরোধী, প্রগতিবিরোধী, বিজ্ঞানবিরোধী, মানবতাবিরোধী ফতোয়া দেয় এবং কারা ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে সেটা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু জানার পরও একটি “সচেতন ও শিক্ষিত” শ্রেণিকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে গজিয়ে ওঠা তালেবানী মতাদর্শের একটি মোল্লাতান্ত্রিক শক্তিকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিচ্ছে। যা দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। এই শ্রেণিটি হঠাৎ করে দেশি তালেবানদের (!) প্রতি এতটাই দরদী হয়ে উঠেছে যে, নৈরাজ্য করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া দেশি তালেবানী গোষ্ঠীর নিহতদেরকে তারা “শহীদ” আখ্যা দিচ্ছে এবং সমস্ত জ্বালাও পোড়াও উন্মাদনাকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে বিভিন্ন যুক্তি ও তর্কের মাধ্যমে। 

দেশি তালেবানদের উত্থান ও ভবিষ্যৎ
ছবিসূত্র: ইন্ডিয়া টুডে


প্রশ্ন হলো, এই গোষ্ঠী নিজেদেরকে প্রগতিশীল দাবি করার পরও কেন ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উপর এত দরদ দেখাচ্ছে? বলা বাহুল্য, এরা নিজেরা কিন্তু ইসলামের শাসন চায় না। এরা অধিকাংশই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস রাখে, অথচ এমন একটি গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে যারা সুযোগ পেলেই তালেবানী শাসন চালাতে দ্বিধা করবে না এবং তেমনটা ঘটলে আজ যেসব ক্লিন শেভ করা স্যুট কোট টাই পরিহিত ভদ্রলোকেরা তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে তাদেরকেই সবার আগে বাধ্য করা হবে দাড়ি রাখতে, টুপি পরতে ও টাখনুর উপর পাজামা উঠাতে। যেসব প্রগতিবাদী নারীরা এই দেশি তালেবানদের উত্থানে উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন তারাই সবার আগে ফতোয়ার কোপে ক্ষত-বিক্ষত হবেন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও চাকরি-বাকরি থেকে বিতাড়িত হবেন, গৃহবন্দী হবেন। তারপরও এই সমর্থনের কারণ কী?

কারণ আর কিছু নয়, এই গোষ্ঠীটি আসলে আমেরিকার মত কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাচ্ছে। 

আশির দশকের আফগান যুদ্ধের ঘটনা কে না জানে? সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তান দখল করল, আমেরিকা দেখল কোনোভাবে যদি ধর্মপ্রাণ আফগানদেরকে জেহাদী জোশে উজ্জীবিত করে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া যায় তাহলে আমেরিকার কোনো সৈন্যের প্রাণহানি ছাড়াই সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আমেরিকা জয়লাভ করবে। প্রাণ যাবে আফগানদের, ধ্বংস হবে আফগানিস্তান- কিন্তু বিজয় পাবে আমেরিকা। এই প্ল্যান মোতাবেক আফগানিস্তানে সি.আই.এ পাঠিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আর সেই সি.আই.এর তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা আফগান যোদ্ধার দলকে আদর করে নাম দিয়েছিল “মুজাহিদিন”। 

তারপর সেই কথিত মুজাহিদিনদেরকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামানো হলো। হাজার হাজার আফগান মারা যেতে লাগলো আর আমেরিকা ও তার ধর্মব্যবসায়ী দোসররা বিশ্বময় প্রচার করতে লাগল এই নিহতদের জীবন বৃথা যাচ্ছে না, তারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হচ্ছে, শাহাদাতের মর্যাদা পাচ্ছে ইত্যাদি! সেই শাহাদাতের মর্যাদা লাভের জন্য আমেরিকা তার নিজের সৈন্যদের না পাঠালেও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার যোদ্ধাকে রিক্রুট করল আফগানিস্তানে জেহাদ করার জন্য।

তারপর লাখো আফগানের রক্তের বিনিময়ে সোভিয়েতের পরাজয়ের পর আফগানিস্তান যখন স্বাধীন হলো, আমেরিকা তখন ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেল। আমেরিকার দৃষ্টিতে এবার সেই মুজাহেদিনরাই হয়ে গেল জঙ্গি, বর্বর, ধর্মান্ধ, উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী। তাদেরকে উৎখাত করার জন্য আফগানিস্তানের মাটিতে গোলা-বারুদের বৃষ্টি বর্ষিত হতে লাগল। যে তালেবান ও আল কায়েদাকে উপরে উঠিয়েছিল আমেরিকা, সেটাকে মাটিতে আছড়েও ফেলল আমেরিকা। কিন্তু এর মাঝখানে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের রক্তের বিনিময়ে রাজনৈতিক স্বার্থ ঠিকই হাসিল করে নিল। 

আজ যারা আমাদের দেশি তালেবানদেরকে মাথায় তুলে নাচছেন, তাদের আসল উদ্দেশ্য কী সেটা আমরা কিন্তু অনেকেই জানি। তারা আছেন সরকার পতনের ধান্দায়। সেই পতন নিশ্চিত করা যদি অন্য কারো পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে “দেশি তালেবান”দের কাজে লাগাতেও তাদের আপত্তি নাই। এইক্ষেত্রে তারা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার প্ল্যানের সাথে একমত। খুবই সহজ পদ্ধতি- দেশি তালেবানদের জেহাদী জোশকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা বা ধ্বংস করে ফেলা, তারপর ক্ষমতায় গিয়ে সেই দেশি তালেবানদেরকে উগ্র, জঙ্গি, বর্বর, সন্ত্রাসী, প্রগতিবিরোধী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে নির্মূল করে ফেলা- ব্যস, খেল খতম।

কিন্তু আসলেই কি খেল খতম? এখানে একটি গড়মিল রয়েছে যেটা এই সরকারবিরোধী রাজনীতির ধারকরা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। পাঠকরা লক্ষ করুন- সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকা মুসলিমদের জেহাদী জোশ নিয়ে খেলেছিল ঠিকই, তবে তাদের নিজেদের দেশে নয়। খেলেছিল আফগানিস্তানের মাটিতে। ফলে আফগানিস্তান ধ্বংস হয়ে গেছে, আর বিজয়ের ট্রফিটা তারা নিজেদের দেশ আমেরিকায় নিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে যারা একই খেলা খেলতে চাচ্ছেন, তারা তাদের বিজয়ের ট্রফি কোথায় নিয়ে যাবেন ভেবে দেখেছেন কি? তারা তো ধর্ম নিয়ে খেলার রঙ্গমঞ্চ হিসেবে নিজেদের দেশকেই বেছে নিয়েছেন। তারা ভুলে গিয়েছেন যে, এই খেলা যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, সেই দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্বই হুমকিতে পড়ে যায়। রাজার সাথে রাজ্যেরও পতন ঘটে যায়। তারা যে সিংহাসনের জন্য এতকিছু করলেন, সেই সিংহাসন নিয়ে বসবেনটা কোথায়? কবরস্থানের উপরে? 

তাদের বোঝা উচিত যে, এটা ধর্ম। এটা এমন এক সেন্টিমেন্ট যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কারো নেই। একবার জেহাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করে দিলে তারপর হাজারও “ওয়ার অন টেররিজম” করেও লাভ হবে না। হ্যাঁ, আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স মুসলিমদের দেশ নিয়ে ও ঈমান নিয়ে খেলতেই পারে, এতে অবাক হবার কিছু নেই। তারা জানে দেশ ধ্বংস হলেও মুসলিমের হবে, ঈমানের অপব্যবহার হলেও মুসলিমের হবে- তাতে আমেরিকার বা ব্রিটেনের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে যারা ধর্ম নিয়ে খেলায় নেমেছেন তারা তো বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নয়, তারা হলেন এদেশেরই সন্তান এবং তাদের ধর্মীয় পরিচয়ও মুসলিম। সুতরাং নিজেদের ধর্মের প্রতি ও দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করতে হবে। এমন কিছু তারা সমর্থন করতে পারেন না যা বিশ্বের বুকে আমাদের ধর্মকে কলঙ্কিত করে এবং দেশকে হুমকিতে ফেলে দেয়। 

এই লেখাটি পড়ে কার কী মনে হবে, কে আমাকে কী ভাববেন, কে আমাকে কোন খোপে ফেলবেন তা আমি জানি না। তবে লেখাটি চলমান রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং একজন বাঙালি মুসলিমের দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছি। হয়ত কারো রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে গেছে, হয়ত কারো রাজনৈতিক স্বার্থের বিপক্ষে গেছে। তবে আমি কারো পক্ষে বা বিপক্ষে লিখিনি, আমি লিখেছি দেশের পক্ষে, ধর্মের পক্ষে। স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক কামড়াকামড়ি আমাদের দেশটাকে খুব বেশি সামনে আগাতে দেয়নি, কিন্তু এবার ধর্ম নিয়ে যেই নোংরা খেলা আরম্ভ হয়েছে তা দেশকে আগানো বা পেছানোর প্রশ্ন নয়, একেবারে ধ্বংসের প্রশ্নে এনে দাঁড় করিয়েছে। এ অবস্থায় চুপ থাকা যায় না। দেশ ও ধর্মের স্বার্থে এই নব-তালেবানী শক্তির মোকাবেলায় সত্যনিষ্ঠ ও শান্তিপ্রিয় মানুষের ঐক্যবদ্ধ হবার এখনই সময়।