নির্বাচিত লেখা

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে রসুলাল্লাহর (সা.) সংগ্রাম

আল্লাহর রসুল (সা.) মানুষ কেনাবেচার দাসত্ব প্রথাকে নির্মূল করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। এই সংগ্রাম কেবল যে কাফেরদের বিরুদ্ধে তা নয়......

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন

প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২১

১. একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সাম্প্রদায়িক ও ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আশ্রয় করেছিলেন। সেই সাথে তখন যেহেতু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার চলছিল, কাজেই সমাজতান্ত্রিক চেতনাও কাজ করছিল অনেক মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে। অন্যদিকে যারা ধর্মব্যবসায়ী ছিল, তারা সরাসরি স্বাধীনতার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কাফের, মুরতাদ, হিন্দু ইত্যাদি আখ্যা দিত। 

২. স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আর ধর্ম নিয়ে ব্যবসা চলবে না। (বাংলার বাণী পত্রিকা, ১৯৭২)

আর ধর্ম নিয়ে ব্যবসা চলবে না


৩. ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেষ্টা করেছিল কিছু বামপন্থী দল। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। 

৪. এরপর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে সেক্যুলার ছিলেন এবং তিনি যে দল গঠন করেছিলেন সেটা একটি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার দল ছিল, কিন্তু তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারায় বিরাট এক পরিবর্তন আনেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে পুনরায় সচল করেন। বলা বাহুল্য, যখন জেনারেল জিয়া বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বৈধতা দিয়েছেন, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বামপন্থাকে মোকাবেলার জন্য ডানপন্থী ও ইসলামপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে ব্যবহার করছিল সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো। যেমন- ওই সময় আফগানিস্তানে চলছিল সোভিয়েতের বিরুদ্ধে তথাকথিত জে/হাদ, যার নেপথ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। একই সময় ইরানে হয়ে গেল ইসলামী বিপ্লব। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ধর্মের একটা উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছিল। খুব সম্ভবত, সেই স্রোতেই গা ভাসাতে চেয়েছিলেন জেনারেল জিয়া। কারণ তখন তার দেশে ও বিদেশে ব্যাপক জনসমর্থন দরকার ছিল, আর বাংলাদেশের ৯০% মানুষ মুসলমান।

৫. জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন আরেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ। তার সময়ে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পশ্চিমা পরাশক্তিরা বামপন্থার মোকাবেলার জন্য ইসলামকে বেছে নিয়েছে। তিনি যে সময়টাতে বাংলাদেশ শাসন করছেন, তখন আফগানিস্তানে চলছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মুজা/হেদিনদের জি/হাদ। সৌদি আরব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলে দিচ্ছে ওই যুদ্ধে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে তখন জে/হাদের উদ্দীপনা ছড়াচ্ছে সৌদি আরবের নিযুক্ত ধর্মব্যবসায়ী আলেম সাহেবরা। ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল তখন ফুলেফেঁপে উঠেছে। ঠিক সেই সময় জেনারেল এরশাদ ঝোপ বুঝে কোপ মারতে চাইলেন। তিনিও জেনারেল জিয়ার মতই ধর্মকে ব্যবহার করা আরম্ভ করলেন। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করলেন, শুক্রবারে ছুটির দিন ঘোষণা করলেন, মসজিদের বিদ্যুৎ বিল সরকারিভাবে মওকুফ করলেন। তার আমলে বাংলাদেশ থেকে বহু মুসলিম যুবক আফগানিস্তানে গিয়েছিল জি/হাদ করার জন্য। বিমানবন্দরে ফুলের মালা দিয়ে তাদেরকে জে/হাদে পাঠানো হত।

৬. জেনারেল এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেশ চালায়। ততদিনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। ধর্মকে ব্যবহার করার স্বাদ পেয়ে গেছে সকলেই। ওদিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে গেছে, কাজেই দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে ভাটার টান চলছিল। বাংলাদেশে ওই শূন্যতাটা পূরণ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। 

৭. এরপর বিগত প্রায় দুই যুগ ধরে বাংলাদেশে চলছে ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি। কী সেক্যুলার, কী জাতীয়তাবাদী- প্রত্যেক দলকেই দেখা যায় ধর্মকে ব্যবহার করতে। তবে এ দৌড়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোই। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইস্যুর গায়ে ধর্মের আবরণ জুড়ে দিয়ে কিছুদিন পরপরই “ধর্ম গেল ধর্ম গেল” জিগির তুলে দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা, হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি আরম্ভ করে। আর বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য প্রতিপক্ষকে কাফের, মুরতাদ ইত্যাদি ফতোয়া দেওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

৮. রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মের অপব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকার ফল কিন্তু এড়ানো যায়নি। দিনদিন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হুজুগ, গুজব, ধর্মীয় উন্মাদনা ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে ও মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে, দেখা গেছে অধিকাংশ ঘটনাতেই পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে বা পরোক্ষভাবে ঘটনা ঘটতে দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী। এ ধরনের হামলায় শুধু ধর্মভিত্তিক দলগুলোই নয়, সেক্যুলার দলের নেতা-কর্মীদেরকেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলো এসব ধর্মীয় উন্মাদনা সংঘটন করে জনগণকে বোঝাতে চায় দ্যাখো দ্যাখো ইসলামকে রক্ষার জন্য আমরা কতকিছু করছি, অন্যদিকে সেক্যুলার দলের নেতা-কর্মীরাও ঘটনা ঘটতে দেয়, কারণ তারা মনে করেন পাবলিক সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করলে রাজনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। ধর্ম নিয়ে এই নোংরা খেলা মোটামুটি অবাধেই চলতে থাকে এবং জনগণের মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়তেই থাকে- যা এখন দেশের জন্য চরম অশনিসংকেত হয়ে উঠেছে।