শাসক জাতির সবকিছুই মিঠা লাগে। শাসক জাতির হাঁটার স্টাইল মিঠা লাগে, খাওয়ার স্টাইল মিঠা লাগে, পোশাকের স্টাইল মিঠা লাগে, কথা বলার স্টাইল মিঠা লাগে- তারচেয়েও বেশি মিঠা লাগে শাসক জাতির শাসনের স্টাইল। ইউরোপীয় প্রভুরা যখন আমাদের শাসক ছিল, তাদেরও সবকিছু আমাদের মিঠা লাগত এবং সবচেয়ে বেশি মিঠা লাগত তাদের উদ্ভাবিত দলাদলির রাজনৈতিক সিস্টেম। প্রভুদের জুতা পরিষ্কার করে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু সময় আমরা পেতাম, স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমরাও প্রভুদের মত সুট কোট পরব, প্রভুদের মত ডাইনিং টেবিলে বসে চামুচ দিয়ে খাব, প্রভুদের মত রাজনৈতিক দল বানাব, দলাদলি করব, নির্বাচন করে ক্ষমতায় গিয়ে প্রভুদের মত সংসদে বসে দেশ চালাব।
প্রভুদের গণতন্ত্র দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত- আহা! কী মধু কী মধু! এত চমৎকার ব্যবস্থা আর হতেই পারে না যে! সবাই মতামত দিতে পারে, দ্বিমত করতে পারে, সমালোচনা করতে পারে- এই তো চাই আমাদের! প্রভুদের প্রতি অন্ধপ্রেম আমাদেরকে এতই অন্ধ করে দিল যে, আমরা ভুলে গেলাম- মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের দেশে আগে থেকেই ছিল। ভারতীয়রা ইউরোপীয়দের মত অসহিষ্ণু ছিল না। এখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করেছে, বিচিত্র ভাষাভাষীর ও বিচিত্র সংস্কৃতির মানুষের সমাহার ঘটেছে। কেউ কারো উপর শত্রুতার ক্রোধ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, কেউ কারো সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম ও মতমত প্রকাশে বাধা দিতে যায়নি (অবশ্য এ ইতিহাস ইউরোপীয়দের আসার আগে পর্যন্ত)।
মত প্রকাশের ক্রাইসিস ছিল বিশেষত ইউরোপের ক্রাইসিস। যেখানে হাজার হাজার ইহুদির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে খ্রিস্টানদের হাত, যেখানে বৈজ্ঞানিক মতামত দেওয়ার অপরাধে চার্চের পুরোহিতরা পুড়িয়ে মেরেছে বহু বিজ্ঞানী ও গবেষককে। তাই ইউরোপীয়রা তৈরি করেছিল এমন একটি মতবাদ যেটা তাদের মধ্যেকার অসহিষ্ণুতার আগুনে একটু পানি ঢালতে পারবে, যেটা তাদেরকে সুযোগ করে দিবে ভিন্নমত প্রকাশের, যেই মতবাদের আশ্রয় নিয়ে তারা একটু সুযোগ পাবে যুক্তিবুদ্ধির আলোকে মুক্তচিন্তা করার। ইউরোপীয়রা জানত- তাদের এই নবআবিষ্কৃত মতবাদ থেকে জন্ম নিতে পারে দলাদলি, ক্ষুন্ন হতে পারে জাতীয় ঐক্য। তাতে ভয়ের কিছু ছিল না, কারণ তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এর চেয়েও বড় ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল।
কিন্তু আমরা কী বুঝলাম কী ভাবলাম তা একমাত্র আল্লাহ মালুম, আমাদের কাছে মনে হলো ইউরোপের এই দলাদলির মতবাদের চেয়ে ভালো কোনো মতবাদ আর হতেই পারে না। ওটাই আমাদের লাগবে, ওটা আমাদের ভারতবর্ষে চালু করতে পারলেই আমরা জাতে উঠতে পারব। আমাদের সেই গোলামী মানসিকতা আমাদেরকে কতটুকু জাতে উঠাতে পেরেছে তা গবেষণার বিষয়, তবে আপাতদৃষ্টিতে আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি- ইউরোপীয়রা দলাদলির যে সিস্টেম তৈরি করেছিল মত প্রকাশের ক্রাইসিস থেকে বাঁচার জন্য, সেটা ইউরোপীয়দেরকে অনেকটা সুফল এনে দিলেও- আমাদের মত গোলামী মানসিকতার দেশগুলোকে ঠিক উল্টো ফল দিয়েছে।
যেখানে এসব তন্ত্র-মন্ত্র ও বাদ-মতবাদের কাজ ছিল ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করতে শেখানো, ভিন্নমতকে উদারভাবে গ্রহণ করতে শেখানো, তার বদলে এই মতবাদ আমাদেরকে আরও বেশি অসহিষ্ণু করে তুলেছে ভিন্নমতের প্রতি। এখন ধর্মীয় মতপার্থক্যের চেয়েও বেশি রক্তক্ষয়ী ইস্যুতে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক মতপার্থক্য। প্রতি বছরই হাজারো গুম, খুন, হামলা, সন্ত্রাস ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটছে রাজনৈতিক কোন্দল ও দলাদলির জেরে। এ সংঘাত শুধু দু’টো ভিন্ন মতাদর্শের দলের মধ্যেই নয়, একই মতাদর্শের একই দলের মধ্যেও এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। রাজনৈতিক কারণে ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে অসুস্থ চর্চা আমাদের সমাজে শুরু হয়েছে, তার বিষাক্ত ছোবল প্রতিদিনই খালি করছে কোনো না কোনো মায়ের কোল।
এখন নির্লজ্জের মত আমরা বলছি- আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই, কথা বলার স্বাধীনতা নাই ইত্যাদি। পরিহাস আর কাকে বলে! যে রোগ আমাদের ছিল না, সেই রোগের ওষুধ আমরা গিলেছি। এখন পাশ্র্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ওই রোগই আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে কিন্তু ওষুধে কোনো সুফল মিলছে না। এদিকে নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে- যখন আমরা আবারও পশ্চিমা প্রভুদের দিকেই হা করে তাকিয়ে থাকছি কিছু একটা সমাধানের আশায়।
তার মানে আমরা ধরেই নিয়েছি জগতের যা কিছু উন্নত- তা ওই পশ্চিমাদের কাছেই আছে, ওরাই সমস্ত উন্নতি প্রগতির ঠিকাদারী নিয়ে রেখেছে, আর ওদের বাইরে যা কিছু আছে তার সবই ভেজাল ও দুর্গন্ধময়, অনেকটা আমাদের পঁচে যাওয়া গোলামী মানসিকতার মত।
মন্তব্য করুন এখানে