নির্বাচিত লেখা

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে রসুলাল্লাহর (সা.) সংগ্রাম

আল্লাহর রসুল (সা.) মানুষ কেনাবেচার দাসত্ব প্রথাকে নির্মূল করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। এই সংগ্রাম কেবল যে কাফেরদের বিরুদ্ধে তা নয়......

যিকির এর সঠিক ও বিকৃত ধারণা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২১

অন্যান্য ধর্মে জিকির
প্রচলিত ধর্মীয় আকিদায় আল্লাহর যিকির করা বলতে আমরা বুঝি কিছু দোয়া বা আল্লাহর গুণবাচক নামকে পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা। যেমন – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সোবাহান আল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ ইত্যাদি শব্দসমষ্টি সংখ্যা গুনে গুনে একশত বার, এক হাজার বার এমন কি এক লক্ষবার পর্যন্ত পড়া হয়। 

কতবার পড়া হলো হিসাব রাখার জন্য একশ দানা বা এক হাজার দানার তসবিহর মালা বা ছড়া (String of prayer beads) ব্যবহার করা হয়। যদিও আল্লাহর রসুল (সা.) কোনোদিন তসবিহ জাতীয় কোনো গণনার উপকরণ ব্যবহার করেছেন বলে হাদিস বা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। 

অবশ্য হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিষ্টান ইত্যাদি সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে তসবিহ (যপমালা বা Rosary) এর ব্যবহার বহু পূর্ব থেকেই ছিল এবং এখনও আছে। সুতরাং তসবিহর ছড়াকে উপাসনার উপকরণ হিসাবে ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায় না। অবশ্য যারা তাসবিহকে উপাসনার উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করার পক্ষে তারা বলে থাকেন যে, আল্লাহ পবত্রি কোর’আনের অনেক জায়গায় তার “তাসবিহ পড়ার” নির্দেশ প্রদান করেছেন। 

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের ‘তাসবিহ’ তথা সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি অধিক তাওবা গ্রহণকারী।’(সুরা নাসর : আয়াত ৩) 

এ আয়াতে কি সংখ্যা গণনা করে আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করতে বলা হয়েছে? নাকি তাসবিহ নামক কোনো মালা ব্যবহার করতে বলা হয়েছে? এমন কিছুই বলা হয় নি। কেবল বলা হয়েছে আল্লাহর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করতে। 

তাসবিহ ঘোষণা ছাড়াও আল্লাহ কোর’আনে মোমেনগণকে সর্বাবস্থায় তাঁর যিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমেনগণ! তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো।’ (সুরা : আহযাব, আয়াত : ৪১)। 

এই যিকির বলতে আল্লাহ কী বুঝিয়েছেন এবং আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবিরা কীভাবে আল্লাহর যিকির করেছেন সেটাই পরবর্তী অংশে আলোচনা করব। 

যিকির শব্দের অর্থ- স্মরণ করা। কোরআন ও হাদিসে যিকিরের বহু মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই শব্দটির আকিদা না বোঝার কারণে এর গুরুত্বটি আমাদের কাছে একটি ভিন্ন অর্থ নিয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ বিচিত্র সব পদ্ধতিতে, দাঁড়িয়ে, গোল হয়ে বসে, মাথা ঝুঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে, তসবিহ গুণে, পাড়া মহল্লা কাঁপিয়ে বার বার আল্লাহর নাম ও গুণাবলী উচ্চারণ করাটাকে আল্লাহর যিকির করা বলে মনে করা হয়। 

কিন্তু কোর’আন-হাদিস-ইতিহাস তন্ন তন্ন করে ঘেঁটেও কেউ দেখাতে পারবে না যে, রাসুল (সা.) একটি দিনের জন্যও তার আসহাবদের নিয়ে মসজিদে নববীতে বা অন্য কোনো স্থানে গোল হয়ে বসে, একত্রে বসে আল্লাহু আল্লাহু যিকির করেছেন বা এই প্রকারের কোনো কার্যকলাপ করেছেন বা সমর্থন করেছেন। 

বরং আমরা দেখতে পাই তিনি জীবনের শেষ দশ বছরে তাঁর সঙ্গীদেরকে নিয়ে ছোট বড় শতাধিক যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেছেন এবং নিজেও তার মধ্যে ২৭টিতে অংশগ্রহণ করেছেন। এই ইতিহাস সর্বজনবিদিত হলেও যারা তসবিহ জপে যিকিরের মাহাত্ম্য প্রচার করেন তারা রসুলাল্লাহর এই সংগ্রামের ইতিহাস চোখে দেখেন না। কারণ একবার সোবাহান আল্লাহ পড়লেই যদি জান্নাত তো বটেই, সেই জান্নাতে সুবিশাল একটি গাছও পাওয়া যায় তাহলে কে এত ত্যাগস্বীকার করে রক্ত ঝরিয়ে জেহাদ করতে যাবে? কী দরকার? 

তারা আসলে ইসলামের উদ্দেশ্য, রসুলাল্লাহর আগমনের উদ্দেশ্য, তাঁর জাতিনির্মাণের উদ্দেশ্য সবই ভুলে গেছেন এবং ত্যাগ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে যিকিরের এই পদ্ধতি বা তরিকাগুলো বিকৃত ভারসাম্যহীন সুফিবাদের মাধ্যমে এই দীনের মধ্যে প্রবেশ করেছে।

যিকির এর সঠিক ও বিকৃত ধারণা  (২য় অংশ)

আল্লাহর রসুল কেন আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন? কারণ কারণ আল্লাহ তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন আল্লাহর দীনকে সমগ্র পৃথিবীতে মানবজাতির জীবনে প্রতিষ্ঠা করে শান্তি, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য (সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা তওবা ৩৩, সুরা সফ ৯)। 

তিনি হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁর উম্মাহকে সেই দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে গড়ে তোলেন। তাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করে গোটা আরব উপদ্বীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর আল্লাহর দরবারে যাওয়ার পূর্বে বাকি পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তিনি তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ করে যান।

আজ আমরা আমাদের উপর আল্লাহ প্রদত্ত সেই দায়িত্বকে পরিত্যাগ করেছি। আমরা আমাদের প্রকৃত ইবাদতকেই ত্যাগ করেছি। পৃথিবীতে যে কাজের জন্য, যে উদ্দেশ্যে আমাদের প্রেরণ করা হয়েছিলো- তাকে ত্যাগ করে, আল্লাহর নাম বা প্রশংসা আমরা যত বিচিত্র, অদ্ভুত উপায়েই উচ্চারণ করতে থাকি না কেন, তা আমাদের বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করবে না। 

মনে রাখতে হবে, আল্লাহর কোন কাজই উদ্দেশ্যবিহীন নয়। ইসলামের কোন আমল বা কাজই অসমন্বিত নয়। আল্লাহ প্রদত্ত মূল উদ্দেশ্যের সাথে ইসলামের প্রতিটি কাজই যথাযোগ্যরূপে সম্পর্কযুক্ত। সেই উদ্দেশ্য পূরণে প্রতিটি কাজেরই তার নিজের অবস্থান, ভূমিকা ও গুরুত্ব রয়েছে। ঠিক যেমন একটি গাড়ির প্রত্যেকটি বড় বা ছোট যন্ত্রাংশেরই আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য রয়েছে কিন্তু সে সবই গাড়ির চূড়ান্ত উদ্দেশ্য অর্থাৎ এক স্থান থেকে অপর স্থানে চলার সঙ্গে সম্পর্কিত। 

তেমনি মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। খলিফা হিসাবে এই পৃথিবীকে তার পরিচালনা করতে হবে। খলিফা নিজে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না- যেখানে মালিকের কোনো সিদ্ধান্ত থাকে। যেখানে মালিকের সিদ্ধান্ত না থাকবে সেখানে সে সিদ্ধান্ত দেবে, তবে সে ব্যাপারেও বহু চিন্তাভাবনা করেই দিতে হবে, যাতে অন্যান্য সিদ্ধান্তের সাথে তার যথাসম্ভব সমন্বয় থাকে। 

বিধান প্রদানে স্রষ্টার যে উদ্দেশ্য ছিল- তা যেন বহাল থাকে। তাহলে আমরা কি দেখতে পাব? খলিফাকে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি কাজে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে, সর্বসময় মালিকের কথাকে স্মরণ করতে হয়। কোন একটা ব্যাপারে যদি তার স্মরণ না থাকে, নিজের নফসের বা চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্তের অনুসরণ করে- তাহলে সেখানেই থাকবে ভুল করার সম্ভাবনা- যা থেকে সমাজে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা, অশান্তি। 

এই যে প্রতিটি কাজে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে- স্রষ্টাকে এবং স্রষ্টা প্রদত্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে স্মরণ করার প্রক্রিয়া, স্রষ্টার আদেশ ও নিষেধগুলো স্মরণে জাগ্রত রেখে পথ চলা - এটাই হচ্ছে যিকির। যদি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সঠিক না থাকে, আকীদা বিকৃত হলে- সেই স্মরণ তখন আর মানুষের পরিচালনার অধীনস্থ এই সৃষ্টির কোন কাজেই আসবে না। আর মূল উদ্দেশ্য পূর্ণ না হলে আল্লাহর কাছেও তার কোন স্বীকৃতি বা প্রতিদান পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই।

যিকির এর সঠিক ও বিকৃত ধারণা  (৩য় অংশ)

যিকিরের একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরুন একজন পিতা শহরে চাকরি করেন। তিনি খবর পেলেন যে তার সন্তান ভীষণ অসুস্থ। তিনি অফিসের বড়সাহেবের কাছে ছুটির আবেদন করলেন। বড় সাহেব বললেন, “এখন তো জরুরি কাজ চলছে। তুমি কালকের দিনটা অফিস করে তারপর যেতে পারো।” 

পিতা ও তার অসুস্থ সন্তান

এখন কল্পনা করুন, সেই পিতা আর যতক্ষণ সময় অফিসের কাজ করবেন ততক্ষণ তার মন কোথায় পড়ে থাকবে? নিশ্চয়ই তার রুগ্ন সন্তানের কাছে। কিন্তু এদিকে অফিসের কাজও নিখুঁতভাবে করে যেতে হবে। এটাই হচ্ছে স্মরণ বা যিকির। 

বান্দা জীবনের প্রয়োজনে সকল কাজই করবে কিন্তু তার মনে সব সময় আল্লাহর স্মরণ সেভাবেই জাগ্রত থাকবে। তাহলে কোনো অবস্থাতেই তার দ্বারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। 

যদি যথার্থ আকীদা অনুযায়ী যিকির করা হয়- তবে তা ভীষণ শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। কারণ মানুষের মনে (ক্বলবে) সর্বক্ষণ তখন আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সম্বন্ধে সচেতনতা থাকে। শয়তান তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। 

বরঞ্চ অতীতে শয়তানের প্ররোচনায় ব্যক্তি কোন ভুল করে থাকলে, কোন বিধানকে লঙ্ঘন করে থাকলে- যিকিরের দরুণ তা স্মরণে আসে এবং সে তখন তওবার মাধ্যমে তা থেকে নিষ্কৃতি পাবার, সংশোধিত হবার উপায় প্রশস্ত হয়। 

মূলত মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিই তার ন্যায় ও অন্যায় সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী। মানুষ যখন তার যাবতীয় কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ নিষেধকে বিস্মৃত হয়, তার পরোয়া না করে- তখনই সে ভ্রান্ত পথে চালিত হয় (সুরা যুমার – ২২)। 

শয়তানের প্রভাবও এখানেই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয়। তখন মানুষ স্রষ্টার নির্দেশনা ও সতর্কতাকে অবহেলা করতে করতে, মানুষের- মানুষ হিসাবে প্রথম মৃত্যু এখানেই হয়। এবার রাসুলের (সা.) এই হাদিসটি লক্ষ করুন-

“ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া (আঃ) ইসরাঈল-তনয়দেরকে বলেছেন: ‘এবং আমি তোমাদেরকে আল্লাহর যিকিরের আদেশ দিচ্ছি, কারণ এর তুলনা এমন এক ব্যক্তির ন্যায় যার পিছনে দুশমন দৌড়ে তাড়া করে ফিরছে, সে সুরক্ষিত দুর্গে প্রবেশ করে নিজকে রক্ষা করেছে। অনুরূপ, বান্দা আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে শয়তান থেকে সুরক্ষা পায়।” (আহমদ) এবং,

“শয়তান প্রতিটি মানুষের ক্বলবের মধ্যে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকে। যখন সে যিকির শুরু করে তখন সে পালিয়ে যায়, আবার যখন আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল হয়- তখন শয়তান আবার ক্বলবে ফিরে এসে ওয়াস ওয়াসা (কুমন্ত্রণা) দিতে থাকে।”

কাজেই মানুষ যদি প্রতিটি সময়, প্রতিটি কাজে যিকির বহাল রাখে, অর্থাৎ আল্লাহ কী আদেশ দিয়েছেন, কী নিষেধ করেছেন তা স্মরণ রাখে, যদি স্মরণ রাখে আমার কাজটি আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে আমাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা- তাহলে তার দ্বারা স্রষ্টার কোন বিধানই লঙ্ঘিত হবে না, বাড়াবাড়িও হবে না। রাসুলের (সা.) আরো বলেছেন,

“নিশ্চয়ই ক্বলব সমুহে মরিচা পড়ে। যেমন ভাবে লোহার মধ্যে পানি লাগলে মরিচা পড়ে। তখন সাহাবায়ে কেরাম (রঃ) বললেন হে আল্লাহর রসুল (সা.) এটা পরিষ্কার করার উপায় কি? জবাবে রাসুল পাক (সা.) বললেন- মৃত্যুকে খুব বেশি বেশি স্মরণ করা আর কোরান তেলওয়াত করা”।

যিকির আলাদা ভাবে গোল হয়ে বসে মাথা ঝাঁকানোর বিভিন্ন ফর্মুলা ও তরিকা বের করে করার মতো কোন আমল নয়। প্রতিটি আমলের সাথে ও নেপথ্যে সে যুক্ত। আকীদার বিকৃতির কারণে আজ তাকে আলাদা আমল বানিয়ে এমন আকৃতি দান করা হয়েছে যে- আজ প্রকৃত যিকির কি জিনিস, সেটা জানার বা চেনারও আর উপায় নেই। অনেকে আবার বাড়াবাড়ির এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, সেই কল্পিত আলাদা আমলটিকে ইসলামের সবকিছুর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে বসে আছে। এই হাদিসটি লক্ষ্য করুন

“মায়াজ ইবনে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, জনৈক ব্যক্তি রসুল পাক (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন মুজাহিদগণের মাঝে সর্বাধিক প্রতিদান ও সওয়াবের অধিকারী কোন ব্যক্তি হবে? 

রসুল পাক (সা.) বললেন: যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে অর্থাৎ যিকির করে। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হলো রোজাদার গণের মধ্যে সর্বোচ্চ সওয়াবের অধিকারী কে হবে? 

তিনি (সা.) বললেন, যে রোজাদার আল্লাহর যিকির সবচেয়ে বেশি করবে। এরূপ ভাবে নামাজ, যাকাত, হজ্ব ,সদকা প্রভৃতি সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করলো। তিনি প্রতিবার একই উত্তর দিলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির সবচেয়ে বেশি করবে সেই সর্বোচ্চ প্রতিদান লাভ করবে।”

মুজাহিদ (সংগ্রামী) পৃথিবীতে একজন মোমেনের সর্বোচ্চ পদ। জিহাদ হচ্ছে সর্বোচ্চ আমল। শাহাদত তাকে আল্লাহপ্রদত্ত সর্বোচ্চ পুরস্কার ও মর্যাদা। একজন মুজাহিদ সমস্ত পৃথিবীর মানুষের শান্তিবিধানের লক্ষ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। নামাজ, যাকাত, হজ্ব, সাদকা, এমনকি এই জিহাদ যারা করছেন তাদের সেই কাজে, যারা আল্লাহর সেই হুকুম পালনের সময়টিতেও আল্লাহকে অধিক স্মরণ রেখে, সেই হুকুম পালনের ক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, তাঁর আদেশ-নিষেধকে যত বেশি স্মরণ করে তা পালন করা হবে- সেই কাজটি তত সঠিক হবে, আল্লাহর কাছে তত বেশি গৃহীত হবে, তত মর্যাদাপূর্ণ হবে।

যিকির এর সঠিক ও বিকৃত ধারণা  (শেষ অংশ)

পৃথিবীতে যিকিরের একটি চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন আলী (রা.) এ প্রসঙ্গে যার উল্লেখ না করলেই নয়। 

“তুমুল যুদ্ধ চলছে এবং যুদ্ধের মাঠে বিরোধীপক্ষের এক যোদ্ধাকে হজরত আলী (রা) ধরাশায়ী করলেন। তাকে মাটিতে ফেলে আলী (রা.) তার বুকের উপর উঠে বসলেন। এমনকি তার মাথা কেটে ফেলার জন্য তরবারীও উত্তোলন করলেন। কিন্তু হঠাৎ শত্রুটি এক বিচিত্র কাজ করে বসলো। সে আলীর (রা.) মুখে থুথু নিক্ষেপ করলো। 

হজরত আলী (রা.) তলোয়ার নামিয়ে নিলেন এবং তার বুক থেকে নেমে পড়লেন। শত্রু এই আচরণে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, হে আলী, তুমি আমাকে মারলে না!  আলী (রা.) বললেন, “যাও- চলে যাও, এখন আর আমি তোমাকে হত্যা করতে পারি না। করলে সেটা ব্যক্তিগত কারণে হবে।”

ইসলামে যুদ্ধ


তাঁর মনোভাব ছিল এই যে, “এতক্ষণ পর্যন্ত আমি ইসলামের জন্য এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে লড়াই করছিলাম। কিন্তু এখন তোমাকে হত্যা করতে গেলে তার মধ্যে আমার ব্যক্তিগত ক্রোধেরও অংশ থাকবে। আর হয়ত আল্লাহর নিকট আমার এই কাজটি প্রতিশোধ হিসাবে গণ্য হবে। তুমি আমার মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আমার যে অসম্মান করলে- আমি তার প্রতিশোধ নিতে চাই না। নিজের সম্মান রক্ষার জন্য এক ব্যক্তি কে হত্যা করার মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই বরং এটা কাপুরুষতার লক্ষণ। যাও, তুমি তোমার লোকদের মধ্যে চলে যাও।”

যিকিরের এর চেয়ে বড় বাস্তব দৃষ্টান্ত আর নেই। যুদ্ধের মতো চরম স্থানেও আল্লাহর আদেশ-নিষেধের স্মরণ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। আর এ কারণেই আলীকে (রা.) আধ্যাত্মিক উন্নতিপ্রাপ্ত বিশেষ ব্যক্তিদের একজন হিসাবে স্বীকার করা হয়- গোল হয়ে বসে বা তসবিহ টিপে ‘আল্লাহু আল্লাহু’ করার কারণে নয়। আল্লাহর রসুল কোনো দুনিয়াবিমুখ, বাস্তব জীবনের সকল সমস্যা থেকে পলায়নকারী সুফি-দরবেশদের আখড়া বসাতে পৃথিবীতে আসেন নি, তাই তিনি জাতির হাতে তসবিহ নয় তলোয়ার তুলে দিয়ে গেছেন। সেই তলোয়ার ঝলসে উঠেছিল সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে। সেই তলোয়ার রক্ষা করেছিল দুর্বল, নিপীড়িত মানুষের অধিকার। প্রতিষ্ঠা করেছিল সাম্য, শান্তি, ন্যায়। 

জাতি যখন সেই তলোয়ার ছেড়ে আকিদাহীন যিকিরের অসিলায় তসবিহ তুলে নিল তখনই জাতি অন্যান্য জাতির দ্বারা পরাজিত হয়ে তাদের পদানত গোলামে পরিণত হয়েছিল। সেই গোলামী আজও চলছে।